বাংলাদেশ সরকার দেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে এবং জনসাধারণের জীবনমানের উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের এ অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে রূপকল্প ২০২১, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১) এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) দলিলে। এ প্রতিশ্রুতির অভীষ্ট লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাসে ইতোমধ্যে অর্জিত অগ্রগতিকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্যের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তার টেকসই সমাধান। পাশাপাশি, দরিদ্র জনগণ যে সকল ঝুঁকিতে রয়েছে তার প্রভাব কমানোর মাধ্যমে এ অগ্রযাত্রাকে দৃঢ়তর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করাও এর লক্ষ্যভুক্ত। এটি অনস্বীকার্য যে দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারের অতীত সাফল্য প্রশংসনীয় হলেও জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ নানাবিধ কারণে এখনো দারিদ্র্যঝুঁকিতে রয়ে গেছে যাদের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠী ছাড়াও রয়েছে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরে অবস্থানকারী কিন্তু নানা কারণে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষজন। দেখা গেছে, দরিদ্র ও প্রায়-দরিদ্র মানুষেরা তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে এসব ঝুঁকি ও বিপর্যয় মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় না। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তাকল্পে সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, দরিদ্র ও দারিদ্র্যঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত এসব কর্মসূচির আওতা ও পরিধি সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ থেকে এটাও দেখা যায় যে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো এসব কর্মসূচির আওতায় আসেনি। তাছাড়া, নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিসমূহ থেকে প্রাপ্ত গড় সুবিধার পরিমাণ খুবই কম এবং প্রকৃত মূল্যে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে একটি কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে গৃহীত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে ব্যয়িত অর্থের যে প্রভাব থাকা উচিত সে তুলনায় এসব কর্মসুচিতে ব্যয়িত অর্থের প্রভাব অনেক কম। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার একটি সমন্বিত ও ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)-কে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বিষয়ক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) তত্ত্ব¡াবধানে জিইডি এ কৌশল প্রণয়ন করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কৌশল প্রণয়নের কর্মপরিধি নির্ধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও এই কমিটির উপর ন্যস্ত হয়। এ কৌশলের বিষয়বস্তু ও সুপারিশমালা রচনায় সহায়তাকল্পে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মশালা, আলাপ-আলোচনা ও সংলাপ আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় প্রণীত সম্পূর্ণভাবে একটি দেশজ কৌশল। সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অতীত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। এ কৌশলের লক্ষ্য হলো বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলির পরিমার্জন ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে এগুলিকে আরও নিখুঁত, দক্ষ ও কার্যকর করে তোলা এবং ব্যয়িত অর্থ থেকে সবার্ধিক সুবিধা অর্জন নিশ্চিত করা। এটি সনাতনী ধারণার পরিবর্তে একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিধির আধুনিক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রচলন ঘ
টাবে। এই নতুন ব্যবস্থায় ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশের (যখন অতিদরিদ্্র মানুষের সংখ্যা হবে ৫ শতাংশের চেয়ে কম) বাস্তবতায় কর্মসংস্থান নীতি ও সামাজিক বিমা ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আওতা ও পরিধি বিস্তৃত করার মাধ্যমে এবং কর্মসূচির নকশা ও আদলের উন্নয়ন ঘটিয়ে এ কৌশল একদিকে যেমন আয় বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে, তেমনি অন্যদিকে এটি মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখবে। সামাজিক নিরাপত্তার এই জাতীয় কৌশলে কেবলমাত্র বাংলাদেশের বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়নি, পাশাপাশি এতে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তলব্ধ জ্ঞান ও ধারণাও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এই কৌশল প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ১০ টি পটভূমিপত্র (ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার) রচনার উদ্যোগ গৃহীত হয়।